Go Back to All Articles একটি চড়, একজন মা ও একজন প্রোগ্রামারের গল্প

এই লেখাটি আমি আমার মা এর স্মরণে লিখছি, যার জন্য আমি এই পৃথিবীতে বেঁচে আছি ও আজকের অবস্থানে আসতে পেরেছি। এই বছরের মার্চ মাসে আমার মা এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। আপনারা সবাই আমার মা এর জন্য দোয়া করবেন।

আজকে আমি একজন প্রোগ্রামার, কিন্তু যদি চিন্তা করি তাহলে এই পথের শুরুটা হয়ত অনেক আগে। আমি প্রথম যে ঘটনাটা মনে করতে পারি তাহল, আমি খাতার মধ্যে কলম দিয়ে অনবরত বিভিন্ন জিনিষ লিখে যাচ্ছি। তখন আমার বয়স মাত্র ৩ বছর। লেখালেখির আমি কিছুই জানি না, আসলে ওগুলো ছিল দাগাদাগি। কিন্তু কেউ আমাকে না বলা সত্ত্বেও আমি যে কিছু লিখতে চাইতাম এটা আমার এখন উল্লেখযোগ্য একটা জিনিষ মনে হয়। মজার ব্যাপার যে এত ছোট বয়সের এই ঘটনাটি আমার এখনো একইভাবে মনে আছে।

এরপর যে ঘটনাটা মনে পরে, আমার মা আমার হাত ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আমাকে ইংরেজি বর্ণমালা লেখা শিখাচ্ছেন। আমার মা এর হাতেই আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি।

আমার শিক্ষাজীবনের শুরুটা ভালো ছিল না। আমার বাবা মা এর অনবরত ঢাকা-সিলেট ভ্রমণের কারণে আমার লেখাপড়ায় অনেক ব্যাঘাত ঘটে। আমি ক্লাস ওয়ানে পরেছি ১ মাস, ক্লাস টুতে ২ মাস, ক্লাস ৩তে ১ মাস। তাই আমার লেখাপড়া আসলে শুরু হয় এক লাফে ক্লাস ফোর থেকে। তাও আবার একটা আধা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে – নাম সেন্ট পেট্রিক্স গ্রামার স্কুল। এই স্কুলটি আমার জীবনের ভিত্তি গড়ায় মাইলফলক হয়ে থাকবে।

তবে ক্লাস ফোরের গল্প বলার আগে, ক্লাস ২ এর একটি ঘটনা বলে নিতে চাই (এটাও সেন্ট পেট্রিক্স গ্রামার স্কুলে), শুধু একটা জিনিষই আমার মনে আছে – আমি জীবনে প্রথম পরীক্ষা দিতে যাচ্ছি। আমার মা আমাকে গুণ করা শিখিয়ে দিচ্ছেন। আমি অনেক অনুশীলন করলাম। কিন্তু পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখলাম, আমার মা আমাকে কেবল শিখিয়েছেন কিভাবে ২টা সংখ্যাকে গুণ করতে হয়, আর পরীক্ষায় এসেছে ৩ টা সংখ্যা গুণ করা। আমি একদম বিচলিত হলাম না, খুব নির্লিপ্তভাবে আমি গুণটা করে দিয়ে চলে আসলাম। ভবিষ্যতে সারা জীবনের প্রতিটা পরীক্ষার পর যেভাবে আমার মা জানতে ছেয়েছেন কিরকম হল পরীক্ষা, ঠিক সেভাবেই সেদিনও জানতে চাইলেন। আমি প্রশ্নপত্র দেখালাম। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন আমি ৩টা সংখ্যা কিভাবে গুণ করেছি। আমি বললাম এ আর এমনকি, ২টা সংখ্যা যেভাবে গুণ করে, আমি একিভাবে ৩টা গুণ করে দিয়েছি। মা আর কিছু বললেন না। কিছুদিন পর পরীক্ষার ফল বের হল। আমি আসলে তখন পরীক্ষা কি, রেজাল্ট কি, এসব কিছুই বুঝতাম না। মা আমাকে স্কুল থেকে ফেরার পথে বললেন, তুমি কি যান তুমি পরীক্ষায় কেমন করেছো? আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, তিনি বললেন আমি ৩য় হয়েছি। আমি তখন বুঝি যে ৩য় কি কিন্তু এটা যে খুশি হবার মত কিছু সেটা আমি তখন মাত্র উপলব্ধি করতে শুরু করলাম। একটু পরে তিনি বললেন আমি আসলে ২য় হয়েছি। এবার খুশিটা আরেকটু বাড়ল। কিন্তু আমার মা ও আমার মধ্যে লেখাপড়া নিয়ে আসলে কখনোই কোন উচ্ছ্বসিত ঘটনা ছিলা না। আমরা কখনো সেলিব্রেট করতাম না, হাসতাম না, সব কিছুই খুব নির্লিপ্ত ছিল, হয়ত একারণে যে আমাদের জীবনটাই তখন অনেক প্রতিকূলতা ও আর্থিক কষ্টের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল যে আমরা ভুলেই গিয়েছিলাম আনন্দ কি জিনিষ।

এখন আসি ক্লাস ফোরের ঘটনায় যেটা আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। আমার মা আমাকে অনেক কষ্ট করে ক্লাস ফোরে ভর্তি করালেন (আবার সেন্ট পেট্রিক্স গ্রামার স্কুলে), কারণ যেহেতু আমি ক্লাস থ্রিতে সিলেটে মাত্র একমাস পরেছি ও কোন টিসি নিয়ে আসিনি, তারা আমাকে নিতে চাইছিলেন না। তো শেষ পর্যন্ত আমার মা অনেক অনুনয় করে প্রিন্সিপ্যাল স্যারকে রাজি করালেন। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের রুমে আমি ইয়া দশাসই পালোয়ানের মত একজন লোককে ঢুকতে দেখালাম, তিনি একটা কাঠের মোটা রুলার নিয়ে চলে গেলেন কোন দুষ্ট শিক্ষার্থীকে সায়েস্তা করার জন্য। তার এই আবির্ভাব আমার কলজে কাঁপিয়ে দিল, আমি ভাবতে লাগলাম কি আছে আমার কপালে।

প্রথম ক্লাসে ঢুকে আমার মনে হল আমি এক ভয়ানক ভিনদেশে চলে এসেছি, চারিদিকে সোরগোল, আমি কিছুই যেন বুঝতে পারছিলাম না। যেহেতু আমি আসলে কখনো এর আগে ঠিকমত লেখাপড়া করিনি, তাই এটা এমন একটা অনুভূতি যা কেবল আমি বুঝতে পারবো বা আমার মত যারা একলাফে ক্লাস ফোরে গেছেন তারা বুঝতে পারবেন। প্রথম ক্লাসটা ছিল ইংরেজি। এখানে অ্যামেরিকান ইংরেজি গ্রামার বই পড়ানো হত, যেটা বড়রাই ঠিকমত বুঝতে পারে না, আমি কেবল হাঁ করে বোর্ডের মধ্যে লেখা এলিয়েন লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে ক্লাস পার করলাম। কিন্তু ২য় ক্লাসটা আমার জন্য যম হয়ে গেল।

এবার আসলেন সেই দশাসই লোকটা, তার নাম ভোলানাথ স্যার। আমি মনে মনে ভাবলাম, এই সেরেছে! কপাল কি খারাপ, তিনি এসেই ক্লাসটেস্ট নিতে শুরু করলেন (পরে জেনেছি যে তিনি প্রায় প্রতি ক্লাসেই আগের দিনের পড়ার উপর টেস্ট নেন)। তিনি বোর্ডে ৩টা অংকের নম্বর লিখে প্রত্যেককে ১, ২, ৩, ১, ২, ৩ এভাবে সিরিয়াল করে বলতে লাগলেন। মানে যার ভাগ্যে যেটা পরবে তার সেটা করতে হবে। একে তো আমি ক্লাস ওয়ান, টু, থ্রি তে বলতে গেলে পড়িইনি, তার উপর এটা আমার প্রথম ক্লাস, আমি আকাশ থেকে পরলাম। আমি বই উল্টেপাল্টে কিছুই বুঝতে পারলাম না, আমার সহপাঠীরা অংক করায় বেস্ত আর যেহেতু কথা বলা নিষেধ তারা আমাকে কোন সাহায্য করতে পারল না। আমি কিছুক্ষণ বসে থেকে চিন্তা করলাম কি করা যায়। আমার সহপাঠীরা কেবল আমাকে এটুকু বলেছে, যে অংক করতে পারবে না, তার হাতে ঐ কাঠের মোটা রুলারের বারি পরবে। আতংকিত হয়ে আমি অংকের নম্বর পরিবর্তন করে অন্য একটা করতে থাকলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছিল ঐটা হয়ত আমি কিছুটা পারতেও পারি। সবার খাতা দেখার শেষে স্যার আসলেন আমারটা দেখতে, আমার অংকটা তিনি কিছুক্ষণ দেখলেন তারপর বললেন হয়নি হাত পাত। আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। আমার মা বা কেউ এর আগে আমাকে কখনো মারেনি। এই প্রথম জীবনে আমি মার খেতে যাচ্ছি। হঠাৎ স্যার বললেন, এক মিনিট, দেখি আবার খাতা। তিনি আমার খাতা নিয়ে বুঝতে পারলেন আমি নম্বর পরিবর্তন করেছি, আর কষে আমাকে তার বিশাল বাঘের মত থাবা হাত ঘুরিয়ে এমন এক চড় মারলেন যে ২ সেকেন্ডের জন্য আমি সর্ষেফুল দেখলাম। তিনি বললেন, এই বয়সেই জালিয়াতি, এত্ত বড় সাহস, আমার সাথে চালাকি?! আমি তখন কিছুই শুনছি না, তখন চারদিক থেকে পৃথিবী আমার জন্য এতটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, যে আমি দাড়িয়ে আছি জ্ঞানশুন্যভাবে যে আমার কোন বোধশক্তি রইল না। সবাই আমার দিকে হয়ত তাকিয়ে ছিল, কেউ হয়ত হেসেছেও, কিন্তু আমি কিছুই দেখিনি।

বাসায় এসে মাকে বললাম কি হয়েছে, তিনি চিন্তিত হলেন তবে আমাকে অভয় দিলেন যে পরদিন থেকে তিনি ক্লাসের পিছনের জানালা দিয়ে বোর্ডে যা লেখায় তা সব লিখে নিয়ে আসবেন। আর ভোলানাথ স্যারের সাথে কথা বলবেন। আমি অভয় পেয়ে ক্লাসে গেলাম। আমি পুরো ক্লাস মজায় বসে রইলাম এটা চিন্তা করে যে আমার মা জানালা দিয়ে সবকিছু লিখে নিচ্ছেন। ভোলানাথ স্যার এসে আমাকে আদর করে দিয়ে বললেন, তুমি বলনি কেন যে তুমি নতুন, তুমি আমাকে বললেই তো আমি তোমাকে মারতাম না। যাই হোক, ভোলানাথ স্যার আশ্বাস দিলেন যে তিনি আমার দিকে বিশেষ নজর রাখবেন।

প্রতিদিন বাসায় এসে আমার মা তার লিখে আনা নোট আমাকে পড়াতেন। তিনি সব ক্লাসে কি কি হোম ওয়ার্ক আছে সব টুকে নিয়ে আসতেন। অনেকটা আমার হয়ে তিনি নিজেই লেখাপড়া করতে থাকলেন। আস্তে আস্তে আমার মা এর সাহায্যে আমি লেখাপড়ায় হাল ধরতে শুরু করলাম। কিন্তু তারপরও আমার মা বুঝতে পারলেন, অ্যামেরিকান ইংরেজি আর অংকগুলো তার জন্য একটু কঠিন। তাই তিনি খুজেখুজে একজন প্রাইভেট শিক্ষক বের করলেন যিনি আমাদের পাড়ায় এক বাড়িতে জায়গীর থেকে পড়াতেন। উনার নাম, শহীদ স্যার। তিনি আরেকজন লোক যিনি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন।

আমি তার কাছে পরতে থাকলাম। আমি বলব সবাই ভালো শিক্ষক হতে পারেন না, ভালো শিক্ষক কি জিনিষ তা আমি তাকে দেখে শিখেছি। তারপরও আমার স্কুলের অ্যামেরিকান ইংরেজি সামাল দিতে তাকেও অনেক বেগ পেতে হয়েছে, ডিকশনারি ঘাটতে হয়েছে। কিন্তু অংকে তিনি ছিলেন খুবই দক্ষ। আর তিনি যেখানে ক্লাস ৯-১০ এর ছাত্রদের পড়াতেন, ক্লাস ৪ তো সেখানে দুধভাত, তবে উনার পড়ানোর কায়দা ছিল অসাধারণ। তিনি প্রথমে আমাকে অংক দেখিয়ে দিতেন, তারপর বারবার আমাকে সেটা করতে বলতেন। আমি ভাল ছাত্র ছিলাম, কোন প্রশ্ন না করে তার কথামত আমি প্রতিদিন একি কাজ করে যেতে থাকলাম। অন্য ছাত্ররা এসে দুষ্টামি করত, তারাতারি চলে যেতে চাইত, অমনোযোগী ছিল, কিন্তু আমি রোবটের মত একের পর এক দিস্তার পর দিস্তা খাতা শেষ করতে লাগলাম। প্রতিটা অংকের পর আমাকে বইের পিছনে অনুশীলনীর উত্তর মিলিয়ে নিশ্চিত হতে হত যে আমার উত্তর সঠিক, একসময় এমন অবস্থা হল যে বইয়ের পিছনে উত্তর দেখে ফেলার আগেই আমি জানতাম যে উত্তর কত। তারপরও আমার রোবটের মত সিস্টেম মত চলার অভ্যাসের কারণে পুরো নিশ্চিত হবার জন্য আমি উত্তর দেখতাম।

আস্তে আস্তে আমি ভোলানাথ স্যারের পছন্দের ছাত্র হয়ে গেলাম। ৯০ ভাগ সময়েই আমি ক্লাসটেস্টে পুরো নম্বর পেতাম। ১ম সাময়িক পরীক্ষায় আমি ৫ম হলাম। মা আমাকে স্যারের সাথে সাথে অন্য বিষয়গুলো পড়াতেন। ২য় সাময়িকেও আমি ৫ম হলাম। ৩য় সাময়িকে আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমি ৫ম হব, তবে একটা ভয় কাজ করছিল যে নীচে না নেমে যাই যেহেতু এটাই বছরের শেষ পরীক্ষা। আবার ইচ্ছা করছিল, একটু উপরে উঠার, কিন্তু এটাতেও আমি আগের মত ৫ম হলাম। শেষ পর্যন্ত রোল ৫ নিয়ে আমি ক্লাস ৫ এ উঠলাম। এটাই প্রথম বছর যেবার আমি পুরো একবছর লেখাপড়া করতে পেরেছি।

ক্লাস ফাইভের একটা খুব স্মরণীয় ঘটনা আছে। ২ টা ক্লাস ফোর সেকশন যোগ হয়ে ক্লাস ফাইভ তৈরি হয়, তাই এখানে আমাদের আগের ক্লাস ফোরের সহপাঠীরা ছিল, আবার অন্য সেকশনের শিক্ষার্থীরাও ছিল, যাদের আমি কখনো দেখিনি। ঐ সেকশনের রোল নম্বর ১ যার ছিল, সে আমাদের সেকশনের রোল ১এর থেকে অনেক ভাল ছিল (সবদিক থেকেই)। তবে আমি একদমি অন্য দুনিয়ায় তখন, আমার ২ বন্ধু জুটেছে। তাদের নিয়ে আমি একদম মজায় আছি। তারা আমাকে খুব হাসাত। তারা লেখাপড়ায় খুব ভালো না হলেও আমরা তিনজন একদম ভালো বন্ধু হয়ে গেলাম। অন্য সেকশনের সেই রোল এক বসত বাম দিকের সারির একদম প্রথম বেঞ্চে, আর আমরা ৩জন সবসময় ডানদিকের শেষ বেঞ্চ দখল করতাম। আসলে ঐ বেঞ্চটাই আমরা চাইতাম।

প্রথম সাময়িক পরীক্ষার আগে, শহীদ স্যার বললেন তিনি আমার একটা বড় ১০০ মার্কের পরীক্ষা নিবেন। এর আগে কখনো তিনি এমন পরীক্ষা নেননি। স্কুলের সাময়িক পরীক্ষা ছাড়া, ১০০ মার্কের পরীক্ষা আমি আর দেখিনি। এই পরীক্ষা অন্যদেরও দিতে হবে। আমার মধ্যে এক অন্যরকম অনুভূতি তৈরি হল, তো একদিন তিনি নিলেন পরীক্ষা। আমি মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষা শেষ হবার ১ সপ্তাহ পার হয়ে গেলেও তিনি রেজাল্ট দিলেন না। আমি কৌতূহলী আবার ভয়ে ভয়ে আছি যে কি হল ব্যাপার। একদিন মাকে বললাম যে তিনি রেজাল্ট কেন দিচ্ছেন না, মা স্যারকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন যে কিছুদিনের মধ্যে তিনি জানাবেন। একদিন যখন আমার মা তাকে বেতন দিতে গেলেন তিনি, আমার খাতা দেখালেন যে আমি ১০০ তে ১০০ পেয়েছি। আমি অবাক, আমার মাও অবাক। তিনি আরও বললেন যে, তিনি চালাকি করে ক্লাস ৭ এর কয়েকটা অংক ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, অথচ আমি একদমই বুঝতে পারিনি। যেহেতু স্যার সব সময় আমাকে অংকের সংখ্যাগুলো বদলে দিতেন আর আমি এতে অভস্ত তাই আমি আসলে লজিক দিয়ে অংক করা শিখে গেছিলাম।

এরপর আসলো স্কুলের ১ম সাময়িক পরীক্ষা। আমি ধরে নিয়েছি, যেহেতু এবার ২ সেকশন যোগ হয়েছে, আমার রোল এবার ৫ থেকেও নীচে পরে যাবার সম্ভাবনা আছে। তারপরও আমি পুরো প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিলাম। একটা কথা বলে রাখা ভালো, আমি লেখাপড়া করলেও কখনো দরজা জানালা বন্ধ করে পরতাম না। আমি নিয়মিত টিভি দেখাতাম, তখন ম্যাকগাইভার হত, এটা খুব মজা করে আমি আর মা দেখাতাম, অন্য সিরিয়ালগুলো, নাটক সব দেখতাম, কোনটাই বাদ দিতাম না, এমনকি পরীক্ষার সময়ও না। মা ও আমি আমরা একসাথেই সব সময় টিভি দেখতাম।

মনে আছে অংক পরীক্ষাটা ছিল শেষ পরীক্ষা, আমি খুব সাবধানে দিলাম। হল থেকে বের হয়ে আসলে মা বরাবরের মত জিজ্ঞাসা করলেন কেমন হয়েছে, আমি খুব খুশি মনে বললাম সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। হঠাৎ মুখ আমার চুপসে গেল, মা কে বলতে গিয়ে আমি মনে মনে মেমরিতে একটা রিভিউ দিচ্ছিলাম যে আমি খাতায় কি লিখেছি। আমি প্রতিটি অক্ষর চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম আর শেষমেশ জ্যামিতির সংজ্ঞা অংশে “কোণ” এর পরিবর্তে বানান ভুল করে আমি “কোন” লিখেছি এটা মনে হওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাকে বললাম, তিনি তেমন কিছুই বললেন না, সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি এটাই বড় কথা। তবে আমার মনে হতে লাগলো, এই বনান ভুলের কারণে স্যার আমার উত্তরটা কেটে দিতে পারেন।

কিছুদিন পর সব টিচার খাতা দিচ্ছেন। আমি বেশিরভাগেই ৮০+ পাচ্ছি, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ঐ রোল নম্বর এক ৯০+, ৯৫+ মার্ক তুলতে থাকলো। আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম যে একি মানুষ না আর কিছু, এত মার্ক পায় কিভাবে? যেহেতু শেষ পরীক্ষা ছিল, তাই অংক পরীক্ষার খাতাও আমাদের শেষে দিতে আসলেন স্যার। বরাবর রোল নম্বর ১ ডানদিকের প্রথম বেঞ্চে আর আমরা ৩ বন্ধু বামদিকের শেষ বেঞ্চে। স্যার একে একে রোল ডাকেন, সে দারায়, তারপর তিনি প্রাপ্ত নম্বর বলেন আর গিয়ে খাতা নিয়ে আসতে হয়। রোল নম্বর ১ বরাবরের মত এখন পর্যন্ত সব সাবজেক্টে টপ স্কোরার। অংকেও সে ৯৫ পেল সম্ভবত। এরপর স্যার আমার রোল ডাকলেন, আমি দাঁড়ালাম। এতখন পর্যন্ত স্যার বাংলায় সবার নম্বর বলছিলেন যেমন, আশি, বিরাশি, নব্বই ইত্যাদি। আমাকে তিনি বললেন হানড্রেড। আমি হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম বুঝার জন্য যে সার আসলে কত বললেন, আমি আসলে বাংলায় নম্বর আশা করছিলাম তাই বুঝতে পারলাম না। বেকুবের মত বেঞ্চে বসতে বসতে মাথায় ঢুকল স্যার কি বলেছেন। আমার বন্ধুরা ততক্ষণে আমার খুশি নিজেদের করে নিয়ে সেলিব্রেশন শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু একটা জিনিষ আমার নজরে পড়লো। আমার নম্বর শুনে পুরো ক্লাসের কেউ তেমন রিএকশন দেখায়নি, কিন্তু রোল নম্বর ১ স্যারের মুখ থেকে কথা বের হবার সাথে সাথে এক ঝটকায় পিছন ফিরে বিস্ফারিত চোখে, পুরো মুখ হাঁ করে স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমার মনে হয় সে ১ মিনিট ওভাবেই তাকিয়ে ছিল। সেই মুহূর্তে আমার ভালো লেগেছে অনেক, তবে আমার কাছে পুরো ঘটনাটা অতো স্পেশাল ছিল না যতটা হয়েছে পরে। যাই হোক, পুরো পরীক্ষায় আমি ২য় হলাম, একটা গিফট ও দিলেন ক্লাস টিচার।

কিন্তু বরাবরের মত আবার আমার স্কুল ছারতে হল। বিশেষ বন্ধুদের ছেড়ে যেতে এবার অমার অনেক কষ্ট হল। আগে কখনো যেহেতু এতদিন একবারে পড়ার সুযোগ হয়নি তাই এবারের এই ধাক্কা আমার জন্য অন্যরকম ছিল। আমি শোকের মধ্যে হারিয়ে গেলাম। আমার পরের পরীক্ষাগুলোয় ভালো রেজাল্ট করার স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। আমি চলে গেলাম সিলেটে। সেখানে ৬-৭ মাস থাকার পর ওখানেও স্কুলে ভর্তি হবার আগেই আবার চলে আসলাম ঢাকায়। এবার বাকি বছরটা বসে বসেই কাটল। কিন্তু এবার আর আগের স্কুলে ক্লাস সিক্সে আমাকে নিল না, তাই বাধ্য হয়ে এবার আমাকে অন্য একটা স্কুলে যেতে হল – মগবাজার টি এন্ড টি হাই স্কুল (এখন নাম বদলে গেছে)। এখানে পরিবেশটা একটু অন্যরকম। কিন্তু আমার সেই দিস্তার পর দিস্তা অংক অনুশীলনের সুফল আমি এখানেও পেতে থাকলাম। এলাম – দেখলাম – জয় করলামের মত আমি এসেই সব অংক পরীক্ষার রেজাল্টের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিতে থাকলাম। অংক টিচার যেন আমার উপর কিছুটা বিরক্তই হলেন, অবাকও হলেন। কারণ আগের যে ফার্স্ট বয় সে গত কয়েক বছর ধরে ফার্স্ট আর তার কাছেই অংক পড়ে। অথচ, আমি এমন বেবধানে থাকে পিছনে ফেললাম যে, তার আর কোন আশা ভরসা থাকলো না। অথচ আমি তখন কোন স্যারের কাছেইপড়ছি না। ১ম সাময়িকে আমি রেকর্ড ভেঙ্গে ফার্স্ট বয়কে পিছনে ফেলে ১ম হয়ে গেলাম। তবে আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম যে আমার তেল ফুরিয়ে আসছে, শহীদ স্যারকে অনেক মিস করতে থাকলাম। কিন্তু কিছু বুঝে উঠার আগেই আবার আমাদের সিলেট যাবার তোড়জোড় শুরু হল, আমার ২য় সাময়িক পরীক্ষা দেয়া হল না, এবার আমি খুবই আপসেট হলাম আর আমার মা বুঝতে পারলেন, এভাবে চলতে দেয়া যায় না, তাই তিনি আমার বাবাকে বললেন যে তিনি এখন সিলেট জাবেন না, আমার মা আমাকে নিয়ে ঢাকায় থেকে গেলেন আমার লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে, বাবা চলে গেলেন সিলেটে। আমি আবার লেখাপড়া শুরু করলাম, কিন্তু মনটাই ভেঙ্গে গেল আর মাঝখান থেকে সব শুরু করতে অসুবিধা হচ্ছিল, শহীদ স্যারও নেই, আমি শেষ পর্যন্ত শেষ সাময়িকে ৩য় হলাম। যেহেতু আমার ২য় সাময়িক পরীক্ষা নেই, তাই আমার গড়ে রেজাল্ট প্রথম ১০ এর মধ্যে কিছু একটা হল (সম্ভবত ৬), যেটা এখন মনে নেই।

ক্লাস ফাইভের সেই ১ম সাময়িক পরীক্ষার পর থেকে আমার জীবনে অনেক ঝড় বয়ে গেছে, আরও অনেক বাধা পার হয়ে আমাকে লেখাপড়া শেষ করতে হয়েছে, কিন্তু সব সময় যখন আমি হতাশ হয়ে পরতাম, আমার কেবল সেই রোল নম্বর ১ এর বিস্মিত মুখ মনে পরত। আমি মনে করতাম আমি স্পেশাল। আমি এমন কিছু করেছি যে আমি যাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে মনে করতাম এবং অন্যরাও মনে করত, তাকে আমি আমার কাজ দিয়ে অবাক করতে পেরেছি। আমি দেখিয়ে দিয়েছি, চাইলে আমি পারফেক্ট পারফরমেন্স বের করে আনতে পারি। তার মানে আমার লিমিট কত তা আমি এখন কি করতে পারছি তা দিয়ে আমি ব্যাখ্যা করব না, আমি চেষ্টা করলে অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারি। পৃথিবীতে কেউ আমার থেকে সেরা নয়। এটা আমার চেষ্টার উপর নির্ভর করে, আমার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। আমি কি করতে পারি তা আমি আমার জীবনের শেষে গিয়েই বলতে পারবো, এর আগে নয়। এই বিশ্বাস পারমাণবিক এনার্জির মত আমাকে ননস্টপ চালাতে থাকলো, সব বাধা আমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেল। আমাকে জীবনে কেউ অনুপ্রেরণা দেয়নি। আমার মা, আমার শিক্ষক, সবাই আমার জন্য অনেক কিছু করেছেন, কিন্তু কেউ আমার অর্জনকে সেলিব্রেট করেননি, পিঠ চাপরে দেননি। আসলে পরিস্থিতি এত খারাপ ছিল যে এটা হয়েই ওঠেনি, বা তারা আসলে অন্য রকম মানুষ যারা বাইরে এগুলো করেন না, ভিতরে ভিতরে খুশি হন। কিন্তু আমার এই অবিরাম পরিশ্রমের জন্য আমার কিছু শক্তি দরকার ছিল। তাই সেই রোল নম্বর ১ কে আমি আজও আমার জীবনের একজন সেরা বন্ধু মনে করি। সে হয়ত এটা কোনদিন জানবেও না যে সে আমার জীবন কিভাবে বদলে দিয়েছে, কিন্তু আমৃত্যু সে আমার একজন সেরা বন্ধু হয়ে থাকবে।

ক্লাস ৭ থেকে ১০ পর্যন্ত আমি যে শিক্ষকদের কাছে পরেছি (ইংরেজি পরেছি শামসুল হক স্যারের কাছে, আর অংক করেছি কবির স্যারের কাছে) তারা আমাকে একই পথে হাঁটিয়েছেন। তাদের সবার মূল মন্ত্র ছিল – কোন শর্টকাট নয়, অনেক প্র্যাকটিস, অনেক পরিশ্রমই সফলতার চাবিকাঠি। তাদের সাহায্যে আমি আমার সাফল্যকে সামনে টেনে নিতে থাকি, আমি মিশতাম কম, পর্দার আড়ালে থেকে আমি একের পর এক রেকর্ড ভাংতে থাকি। আমাকে নিয়ে স্কুলে অনেক গল্প চালু হয়ে যায়। অন্য সেকশনের স্টুডেন্টরা অন্য সবাইকে চিনলেও আমাকে চিনতেন না। স্কুলের সবার আশা ছিল, আমি স্ট্যান্ড করব। কিন্তু তখন আমি আবার পথ হারাই। আমার জন্ডিস হয় ক্লাস নাইনে, আবার তখনি আমার মা অসুস্থ হয়ে পরেন, যেটা তার শেষ জীবন পর্যন্ত আর ভালো হয়নি। তারপরও আমি ক্লাস নাইনে এক বছর ড্রপ দিয়ে আবার ১ম হয়ে ক্লাস টেন এ উঠি। কিন্তু আমার মা এর অসুস্থতার জন্য হতাশার শক্তি এত গাড় হতে থাকে যে তখন আমি ভিডিও গেমের প্রতি আসক্ত হয়ে পরি। আর দিনরাত গেম খেলতে থাকি, এর ফলে আমি এত পিছিয়ে পরি যে, এস এস সি মডেল টেস্টে ধর্ম পরীক্ষায় আমি ফেল করবো ভেবেছিলাম। আমার একটাও প্রশ্ন কমন পরেনি। আমি নকল করবো ভাবছিলাম, পরে ধর্ম পরীক্ষা চিন্তা করে, আর জীবনে কখনো নকল করিনি চিন্তা করে, আল্লাহ্‌র কাছে সাহায্য চাই পরীক্ষার হলে এবং নিজেই বানিয়ে বানিয়ে লিখে দিয়ে কিভাবে যেন পাশ করে আসি। আল্লাহ্‌ চাইলে কি না হয়।

শেষ পর্যন্ত আমি জাস্ট স্টার মার্ক আর ৪ লেটার মার্ক নিয়ে পাশ করি। অনেক কাঠখড় পুরিয়ে সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হই। আসলে আমি কোথাও চান্স পাচ্ছিলাম না। অনেক আশা ছিল নটরডেমে যাব, কিন্তু আমার স্কোর কম থাকায় আমাকে পরীক্ষাই দিতে দেয়নি। কলেজ জীবন ছিল আমার জন্য এক নরক। আমার ভিডিও গেমের নেশা, মা এর অসুস্থতা সব কিছু আমার উপর এমনভাবে চেপে বসে যে আমি হঠাৎ পুরোদমে একজন ফেল করা ছাত্রে পরিনত হই। মনে আছে একবার আমি পরীক্ষায় নকল করে ধরাও পরি। ওটাই অবশ্য প্রথম ও শেষ। কিন্তু যেখানে স্কুলে সবাই এটা বিশ্বাস করত যে আমার পায়ের নীচে পুরো বই দিয়ে রাখলেও আমি পরীক্ষায় খুলে দেখব না, তার জন্য এতটা অধঃপতন বলে দেয় আমি আসলে তখন কি অবস্থায় ছিলাম। আসলে আমি স্কুলে সবার কাছে যেভাবে কেয়ার পেয়েছি, কলেজে সেটা ছিল না। কলেজে সবাই নিজ নিজ দায়িত্বে লেখাপড়া করত, আর স্কুলে আমার মা ও আমার শিক্ষকরা আমাকে গাইড করতেন। তাদের সাপোর্ট হঠাৎ আমার উপর থেকে সরে যাওয়ায় আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই আমার পা এর নীচে মাটি সরে যায়। কোন মতে ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে পাশ করে এসে আমি রক্ষা পাই, কিন্তু তার জন্যও আমাকে একবছর ড্রপ দিতে হয়েছে, আমি এতটাই পিছনে পরে গিয়েছিলাম যে এইচ এস সি পরীক্ষা চলাকালীন আমি ফিজিক্স পরীক্ষার দিন আর চাপ সহ্য করতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেই পরীক্ষার হলে না যাওয়ার।

এইচ এস সি পাস করার পর আমি খুশি হলেও, আমি বিষণ্ণ হয়ে পরি এই চিন্তা করে যে আমি বুয়েটে চান্স পাব না। আমার তখন ধারণা ছিল কেবল বুয়েটে কম্পিউটার সায়েন্স পড়া যায়। তাই আমি ঠিক করলাম আমি লেখাপড়া ছেড়ে দিব। কলেজে অন্য বিষয়ের উপর লেখাপড়া করে আমার জীবনের স্বপ্ন পূরণ হবে না। আমি প্রোগ্রামার হতে পারবো না। তার থেকে ভালো আয় রোজগারে মন দেই, যদি টাকা বানাতে পারি তাহলে একদিন নিজে নিজেই প্রোগ্রামার হবার চেষ্টা করতে পারবো। আমি আমার মাকে নিয়ে ঢাকা থেকে চলে যাই রাজশাহী, সেখানে আমার এক কলেজের বন্ধু আমাকে ফার্ম করার বুদ্ধি দেয়, কিন্তু শেষমেষ আমি তার সাথে কাজ না করে একাই চেষ্টা করি, কিন্তু তাতেও কাজ হয় না, আমার মা আরও অসুস্থ হয়ে গেলে আমি আমার বাবাকে বলি আমাকে বিজনেসে সাহায্য করতে। বাবা আমাকে বলেন লেখাপড়া চালিয়ে যেতে। আসলে আমি যে রাজশাহী চলে গেছি, এটা বাবা জানতেন না। আমি সিলেটে বাবার কাছে গেলে তিনি আমার ফুফার সাথে আমাকে কথা বলান, তিনি আমাকে একটা কথা বলেন যেটা আমার জীবনে অনেক কাজে লাগে। এই মানুষটাকে আমি অনেক ঘৃণা করি, কারণ তিনি আমাদের সাথে একসময় অনেক খারাপ ব্যাবহার করেছেন, কিন্তু এই একটা কথার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। তিনি আমাকে বললেন – “যে আজ দোকান দিয়েছে, সে বা তার বাপ দাদা একদিন অন্যের দোকানে কর্মচারী ছিল। তুমি অভিজ্ঞতা ছাড়া বিজনেস করে সফল হবে না।“ এরপর আমি পরাজিত সৈনিকের মত আবার ঢাকায় আমার নানাবাড়িতে চলে আসি। আল্লাহর অশেষ রহমত যে তিনি আমার মামার মাধ্যমে আমাকে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সে ভর্তির জন্য টাকা দেন। আসলে এতগুলো টাকা তখন আমাদের জন্য জোগাড় করা সম্ভব ছিল না। যদিও তিনি টাকা দিতে চেয়েছিলেন আমাকে প্রাইভেটে ডাক্তারি পড়ানোর জন্য। কারণ আমাদের বাড়ির সবার স্বপ্ন ছিল আমি ডাক্তার হব। কিন্তু আমি সাফ জানিয়ে দেই, যদি আমি কিছু হই তো কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হব, নয়ত কিছুই হব না। প্রথমে আমি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে চেষ্টা করি, কিন্তু সেখানেও আমি চান্স পাই না, আমাকে বিবিএ অফার করা হয়। আমার নানু, যিনি আমার মা অসুস্থ হবার পর থেকে আমাকে বিরামহীনভাবে লেখাপড়ায় সাহায্য করেছেন, তিনিও বিরক্ত হয়ে আমাকে কিছু কড়া কথা বলেন যে আমি কোথাও চান্স পাওয়ার যোগ্য না। আমি তখন দাঁতে দাঁত চেপে চুপ করে থাকতাম। হ্যাঁ, স্কুলের সেই ঘটনা এখানেও আমাকে মানসিক শক্তি যোগায়।

অ্যামেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি – বাংলাদেশে (এ আই ইয়উ বি) আমি খুব সহজে ভর্তি হয়ে যাই, যেটা আমার জীবনের মোড় বদলে আরেকটি ধাপ। ভর্তি হবার আগে সেই কঠিন সময়ে আমি আল্লাহ্‌কে কেবল একটা কথাই বলতাম, হে আল্লাহ্‌, তুমি কেবল আমাকে ভর্তিটা করে দাও, এরপর প্রোগ্রামার হওয়া আমার দায়িত্ব। আসলে আল্লাহ্‌ পুরো দায়িত্বটাই নিয়ে নেন।

ভর্তির প্রথম থেকেই আমার একটাই লক্ষ্য ছিল – “ভালো প্রোগ্রামার হওয়া”। জীবনের হতাশার দিনগুলো আমার জন্য এত দুর্বিষহ ছিল, যে আমি আর কোন মতেই যেন পা না পিছলায় সে ব্যাপারে সতর্ক হয়ে উঠি। আমি রাতদিন চেষ্টা করতে থাকি। যে যন্ত্রটা সারা জীবন কেনার স্বপ্ন ছিল, কিন্তু ধরতে পারিনি, কেবল ম্যাগাজিনে ছবি দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে, সেই কম্পিউটার আমার বাসায় আসলো। ইন্টারনেট আসলো। আমি কম্পিউটার ডেলিভারিম্যানকে জিজ্ঞাসা করলাম, কিভাবে এটা বন্ধ করতে হয়, দেখিয়ে দিয়ে যান। কারণ তিনি কিভাবে চালু করতে হয়ে দেখিয়েছেন। কিভাবে বন্ধ করতে হয়, এটাই ছিল আমার একমাত্র প্রশ্ন। মাঝখানে বাকি সব আমি নিজে নিজেই শিখে নিয়েছি। সবচেয়ে ভয়ের কাজ ছিল, উইন্ডোজ এক্সপি ইন্সটল করা, আমার বন্ধু সৈকত এই কাজে এক্সপার্ট ছিল, তার কাছ থেকে এই জিনিষটি শিখে নেই।

৩য় সেমিস্টারে সি প্রোগ্রামিং কোর্স নেই। সেমিস্টার ব্রেকে আমি আর আমার বন্ধু সৈকত আগাম প্রস্তুতি নিতে থাকি। তখন আমাদের ইউনিভার্সিটিতে টার্বো সি দিয়ে প্রোগ্রামিং শেখানো হত। আমাদের সেকশনে একজন নতুন টিচার আসেন তিনি সিগুইন দিয়ে আমাদের সেখাতে থাকেন। যাই হোক অনেক ঘটনা এখানে ঘটে, পিকনিকে আমার প্রোগ্রামিং বই নিয়ে যাওয়া, IF Else দিয়ে বোকার মত ৫,০০০ লাইন কোড করে গেম বানানো, আরও অনেক কিছু। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার নিরলস চেষ্টার ফলে আমি সি কোর্সে ১০০ তে ১১০ পাই। ১০ মার্ক বোনাস ছিল। একদিন আমি বিডি চ্যাট সাইটে যাই। তখন এটা ফেসবুকের মত ছিল। সেখানে দোলন নামে একজনকে আমি নক করি। তিনি আমার পরিচয় জানতে চান। আমি তখন খুশিতে আটখানা, এত দিনে আমার প্রোগ্রামার হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে, কারণ আমি ১১০ পেয়েছি, যেখানে আমার অন্য সহপাঠীরা ভয়ে সি কোর্স ড্রপ করে। তাকে আমি বললাম, আমি একজন প্রোগ্রামার। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন কোথায়? আমি বললাম আমি এখনো স্টুডেন্ট। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি ভালো করছি কিনা, আমি বললাম আমি অনেক ভালো, আমি সি কোর্সে ১১০ পেয়ছি। বুঝতেই পারছেন, তার উত্তর ছিল একটা স্মাইলি। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন আমি ACM প্রবলেম সল্ভ করি কিনা। আমি এর কিছু দিন আগে কোনভাবে UVA সাইটএ গিয়েছিলাম। স্বভাবতই কিছু না বুঝতে পেরে চলে আসি। তার কথায় আমি একটু বিব্রত হলাম, তাকে বললাম, সল্ভ করিনি কিন্তু দেখেছি। তিনি আমাকে ওখানে অনুশীলন করতে বলেলেন। তিনি নিজে একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেন, মনে নেই কোথায়। কিন্তু এই মানুষটি আরেকজন মানুষ যার সাথে কথা না বলা হলে হয়ত আমার প্রোগ্রামার হওয়ার স্বপ্ন গতি পেত না।

ঐ লোকের কথার রেশ ধরে আমি UVA ও ACM প্রোগ্রামিং নিয়ে সিরিয়াস হয়ে যাই। মজার ব্যাপার, ঠিক তখনি আমাদের ইউনিভার্সিটিতে জাহিদ সবুর ভাই প্রোগ্রামিং এ খুব ভাল করছিলেন। আর একারণে আমাদের ইউনিভার্সিটি এই বিষয়ে খুব গুরুত্ব দিতে থাকে। এর রেশ ধরে, তারা মোঃ কাম্রুজ্জামান স্যারকে আমাদের ইউনিভার্সিটিতে প্রশিক্ষক হিসাবে নিযুক্ত করেন। তিনি নতুন ট্যালেন্ট হান্ট করার জন্য পুরো ইউনিভার্সিটিতে পোস্টার লাগান। আমি সুযোগ লুফে নিয়ে অ্যাপ্লাই করি। কিন্তু সেলেকশন টেস্টে আমি একটাও সল্ভ করতে পারি না, কারণ সেই একই প্রবলেম, UVA প্রবলেম ফরম্যাটগুলো না বুঝলে আসলে সল্ভ করা যায় না। সৌভাগ্য, এরপর আরেকটি লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয় যেখানে আমি প্রথম ৪০ এর ভিতরে কোনভাবে টিকে গিয়ে জুনিয়র টিমে ঢুকে যাই।

ধিরে ধিরে আমি সেখানেও সিরিয়াসলি অনুশীলনের মাধ্যমে এগিয়ে যেতে থাকি। অনেক অগুছাল ভাবে আমি আমার বন্ধুদের নিয়ে একটা টিম তৈরি করি, তখন সবুর ভাইএর ৫০০+ প্রবলেম সল্ভ। আমি প্রথম প্রবলেম সল্ভ করার পর আমার টিমকে ডেকে বললাম যে চাইলে একদিন আমরাও ৫০০ প্রবলেম সল্ভ করতে পারবো। তারা আমার কথায় হাসল। মজার ব্যাপার ২ বছর পর যখন আমি পাস করে বের হই ততদিনে আমার ৫৫০+ এর বেশি সল্ভ হয়ে গেছে।

প্রোগ্রামিং কনটেস্ট করাকালীন আমি লক্ষ্য করেছি, আমার চিন্তা শক্তি ও বুদ্ধি আগের থেকে বেড়েছে। আমি খুব সহজে অনেক কম পড়েই ভালো গ্রেড পেতে থাকলাম। লেখাপড়া আমার কাছে অনেক সহজ হয়ে গেল।

পাস করার পর প্রথম চাকরি পেতে আমার সামান্য বেগ পেতে হয়েছে। কিন্তু যখন যেখানেই আমি কাজ করতে যাই, সব ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করেছি আমার কাজে আমি অন্যদের থেকে কিছুটা এগিয়ে আছি। সেই সূত্র ধরেই আমি ডেভস্কিলকে গড়ে তুলার চেষ্টা করছি, যাতে আমার মত আরও অনেকে প্রোগ্রামিং এ ভালো করতে পারে।

এখানে অনেক ছোটখাটো মজার ঘটনা আমি এড়িয়ে গেছি, যা বলতে গেলে হয়ত অনেক লম্বা হয়ে যাবে। কিন্তু সারমর্ম এই যে, জীবনে আমাদের চারপাশে অনেক কিছুই ঘটে যা আমাদের জীবন বদলে দেয়। জীবনে সমস্যা থাকবে, কষ্ট থাকবে, তারপরও চেষ্টা আর একাগ্রতা মানুষকে অনেকদূর নিয়ে যেতে পারে। আমি নিজেকে আহামরি মেধাবী কখনোই মনে করি না, আমার জীবনে যা কিছু অর্জন তা আমার যোদ্ধা মনোভাবের ফল। আর আমার জীবনের যুদ্ধ শেষ হয়নি, বরং এখন যুদ্ধটা এত ব্যাপক যে বলা উচিৎ এখন তো কেবল শুরু, এতদিন ছিল প্রস্তুতি।

যারা জীবনে হতাশ হয়ে পরে, মনে করেন – আমার দ্বারা সম্ভব নয়, তাদের আমি বলতে চাই, অনেক কিছুই সম্ভব যদি আপনি বিশ্বাস করেন ও সেই মত চেষ্টা করেন। পরিশ্রম, একাগ্রতা, বিচক্ষণতা এই জিনিষগুলোই আসলে জীবনকে বদলে দেয়, আমরা কিন্তু এই জিনিষগুলো চিন্তা করে জীবনে চলি না, আমরা বরং কিছু কাজ করি, কিছু জিনিষ বিশ্বাস করি, কিছু সিদ্ধান্ত নেই, কিছু লক্ষ্য করি যেগুলো পরে আমাদের জীবনে পরিশ্রম, একাগ্রতা, বিচক্ষণতা হয়ে দারায়। তাই আমাদের কাজ, কথা, চিন্তা, সিদ্ধান্ত ইত্যাদিকে আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করতে হবে। আমি একটা জিনিষ বিশ্বাস করি, মানুষ তখনি হারে যখন সে বলে আমি হেরে গেছি, এর আগে নয়। আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, জীবনের এতগুলো দিন একসাথে যুদ্ধ করার পর, এখন আমি আমার মাকে ছাড়া আমার জীবনকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাব ইন শা আল্লাহ্‌। তাই আমরা সবাই লড়াই করছি, আমাদের প্রতেকের যুদ্ধ আলাদা কিন্তু আমরা সবাই যোদ্ধা।

সবার জন্য সফল ক্যারিয়ারের শুভকামনা রইল।

মোঃ জালাল উদ্দিন,

প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ডেভস্কিল.কম

Share with Your Friends