Go Back to All Articles যেভাবে একজন প্রোগ্রামারের জীবন ধ্বংস হয় (কেস স্টাডি ৩)

কম্পিউটারের স্ক্রীনের দিকে শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তারেক। মাথার ভিতরটা ঝিম ঝিম করছে তার। ক্লান্তিতে শরীরটা ভেঙে আসছে। চোখগুলো লাল টকটকে, মাথার চুল এলোমেলো, চেহারা থমথমে। অপরিচিত কেউ দেখলে মাতাল ভেবে বসতে পারে। একটু বিশ্রাম নিতে পারলে বেশ হত – ভাবলেন তিনি, কিন্তু আজকে প্রোজেক্টের ডেড লাইন। যত রাতই হোক কাজ শেষ করেই বাসায় যাবেন ঠিক করেছেন। তাই শেষ ভরসা হিসাবে অফিসের বারান্দায় গিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে চেয়ারে হেলান দিলেন তিনি। ভাবছেন কিভাবে কাজটা তাড়াতাড়ি শেষ করা যায়।

তারেক একটা প্রতিষ্ঠিত সফটওয়্যার কোম্পানিতে টিম লিড পদে আছেন গত ৩ বছর ধরে। মোট অভিজ্ঞতা ৫ বছর। অনেক দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করে এখানে পৌঁছেছেন। বেতনও বন্ধুদের তুলনায় ভালই পান। সমস্যা শুধু একটাই, অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতে হয়। বিয়ে করেছেন ২ বছর হল, স্ত্রী রিমি বেশ সহনশীল মানসিকতার, তাই পরিবার নিয়ে তেমন কোন ঝামেলা নেই। আত্মীয়স্বজনরা আজকাল আর তারেকের তেমন একটা দেখা পান না। ছুটির দিনগুলোতেও তারেকের এত ক্লান্ত লাগে যে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না। তার উপর আবার ট্রাফিক জ্যাম। তাই কিছুটা বিচ্ছিন্ন জীবনই কাটছে বলা যায়। তবে এটা নিয়ে তেমন ভাবেন না তারেক। তার মূল লক্ষ্য কিভাবে ক্যারিয়ারে উন্নতি করা যায়। এখনই তো সময় কাজ করার।

তারেক বেশ মেধাবী। নিয়মিত নিজেকে আপডেটেড রাখতে ব্লগ, আর্টিকেলও পড়েন। কিভাবে ভালো কোড করা যায়, ইদানীং এটা নিয়ে বেশ মাথা ঘামাচ্ছেন। কিন্তু নিজে ব্লগ বা আর্টিকেল লিখতে গেলে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় তার, গুছিয়ে লিখতে পারেন না। আর গুছিয়ে ভাল মানের লেখা লিখতে গেলে বেশ সময়ও লাগে, সেই সময়টাও তিনি পান না। তাই আর লেখা হয়ে উঠে না। সার্টিফিকেশন নেন না, কারণ তিনি মনে করেন আমাদের দেশে যারা সার্টিফিকেশন নেয় তারা আসলে তেমন কিছুই পারেন না, সার্টিফিকেশন দিয়ে নিজের অযোগ্যতা আড়াল করার চেষ্টা করেন। আর এর জন্যও তো সময় নিয়ে লেখাপড়া করতে হবে, সেই ফুরসৎ তার হল কবে? মাঝে মাঝে সেমিনারে বক্তা হিসাবে আমন্ত্রণ পান, কিন্তু ফিরিয়ে দেন তিনি। এত মানুষের সামনে কথা বলতে খুবই অস্বস্তি লাগে তার – হ্যাঁ অস্বস্তি, কারণ যদিও এটা ভয় ও সংকোচের সংমিশ্রণ কিন্তু এই বয়সে ভয় পান কথাটা ভাবতে চান না তিনি। আর তাই অনেক ঝানু প্রোগ্রামার হওয়া সত্ত্বেও কেউ চেনে না তারেককে। কিন্তু তা নিয়ে তিনি একদম ভাবেন না, বরং নিজের কাজ নিয়ে আড়ালে থাকতেই পছন্দ তার।

সিগারেটে টান দিতে দিতে শুরুর দিকের কথা মনে পরে গেলো তার। অনেক পরিশ্রম করেছেন জীবনে এই পর্যায় আসতে। কোনদিন কোন প্রোজেক্ট মাটিতে পরতে দেননি, যথা সময়ে প্রোজেক্ট ডেলিভারি দেবার রেকর্ড আছে তার। মাঝে মাঝে মাঝরাতেও বাসায় গেছেন, হাইজ্যাক হয়েছেন ২ বার। এত কিছুর পরও পেশাটাকে ভালবাসেন তিনি। অনেক ভালো কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু কিভাবে করবেন বুঝতে পারছেন না। সময় চলে যাচ্ছে, কিন্তু যে জিনিষগুলো শিখতে চান তা শেখা হয়ে উঠছে না। এই যেমন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এর বিষয়গুলো বইতে বা ব্লগে যেভাবে পড়েন, সেভাবে করতে পারছেন না বলে অনেক দিনের আফসোস আছে তার। মনে পরে, একবার এক প্রোজেক্টে অ্যাপ্লাই করতে গিয়ে প্রোজেক্টই ফেইল হতে বসেছিল। কোথায় সময় কমবে আশা ছিল, উল্টো শেষ পর্যন্ত রাতদিন কাজ করে প্রোজেক্ট বাঁচাতে হয়েছে তার। এরপর অনেকদিন হল, আর সাহস করে উঠেননি। জুনিয়ররা মাঝে মাঝে খুব বায়না ধরে এই নিয়ে, কিন্তু নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে তাদের তিনি বুঝিয়ে দেন যে এসব আসলে গুগল, মাইক্রোসফটের জন্য, আমাদের জন্য নয়। তবে নতুন নতুন টুলস, আর প্লাগ-ইন ব্যাবহারে তিনি তাদের উৎসাহিত করেন। আর ভালো কোড লিখতে এক রকম জোরই করেন।

বন্ধুদের মধ্যে বেশিরভাগই বিদেশে চলে গেছে। কিন্তু নিজের দেশই ভালো লাগে তার। কিন্তু এও বুঝতে পারছেন না যে ভবিষ্যৎ তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আর কত দিন এভাবে কাজ করবেন। মাঝে মাঝে মনে হয় চাকরি বদলে অন্য কোন কোম্পানিতে যাবেন, কিন্তু দেশে তার যাওয়ার মত ভালো মানের কোম্পানি আছে হাতে গোনা কয়েকটা। আর সেখানেও তেমন আহামরি পার্থক্য তিনি আশা করেন না। দিন দিন নিজের কাজের স্পীড কমে আসছে বলে মনে হচ্ছে তার। যা শিখছেন তা অ্যাপ্লাই করতে পারছেন না। একই বৃত্তের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। আসলেই কি যে হারে নিজেকে উন্নত করা দরকার সে হারে তা করতে পারছেন? নিজের জীবন নিয়ে এক অনিশ্চয়তার শঙ্কা কাজ করছে তার মধ্যে। হঠাৎ ঘড়ির দিকে চোখ পরল তার, দেরি হয়ে যাচ্ছে, সিগারেটটা তারাতারি শেষ করে কাজে ফিরে গেলেন তিনি। হয়ত এভাবেই দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে আরও ৫ টা বছর।

তারেক সাহেব কোন কাল্পনিক চরিত্র নয়। আমাদের দেশের প্রতিটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে অন্তত একজন তারেক সাহেব পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রশ্ন, তারেক সাহেবের ক্যারিয়ার কি নষ্ট হচ্ছে? আগের কেস স্টাডিগুলোতে আমরা দেখেছি, যারা খামখেয়ালি করেন, নিজেকে আপডেটেড রাখেন না, তারা ভুক্তভোগী হন। কিন্তু তারেক সাহেবের কি দোষ? হ্যাঁ, তিনিও ভুল করেছেন, চলুন দেখা যাক তার ভুলগুলো কোথায় ছিল-

আমাদের দেশে বেশির ভাগ সফটওয়্যার কোম্পানিতে টিম লিডই হচ্ছে সবচেয়ে উপরের টেকনিক্যাল পোস্ট। অল্প কিছু বড় কোম্পানিতে প্রোজেক্ট ম্যানেজার ও সিটিও থাকে। সেক্ষেত্রে একটি কোম্পানিকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব আসলে একজন টিম লিডের ঘাড়েই বর্তায়। কিন্তু কোম্পানিগুলো যেমন টিম লিডদের এই দৃষ্টিভঙ্গিটি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমন টিম লিডরাও প্রোজেক্ট সময় মত শেষ করাকেই চাকরিতে নিজের শেষ দায়িত্ব মনে করছেন। অথচ নিজের ক্যারিয়ার বাঁচানোর জন্যই যে কোম্পানিকে তার গাইড করা প্রয়োজন তিনি তা বুঝেন না। কোম্পানির মালিক একজন বিজনেস পার্সন। তার কাজ বিজনেস সামাল দেয়া। একটি সফটওয়্যার কোম্পানি কোন পথে হাঁটবে সে গাইডলাইন তিনি দিবেন এটা আশা না করে, তাকে এই কাজে টিমলিড সাহায্য করতে পারেন। মনে রাখতে হবে, আমরা কি করতে পারি আর কি পারি না এটা কেবল একটি মানসিক প্রতিবন্ধকতা। আপনি যদি ভাবেন, আমি টিম লিড, প্রোজেক্ট ডেলিভারি দেবার পর আমার দায়িত্ব শেষ, অতিরিক্ত কিছু করার ক্ষমতা আমার নেই, আর এর জন্য আমি তো টাকা পাব না, তখন আসলেই আপনি এই কাজগুলো করতে পারবেন না। কিন্তু একটু অন্যভাবে চিন্তা করুন, যদি আপনি একটা কোম্পানিকে রাতারাতি বদলে দিতে পারেন, তাহলে সেই কোম্পানি কি আপনাকে হারাতে চাইবে? আর অন্য কোম্পানিগুলো যখন দেখবে যে আপনি এই কোম্পানিকে বিশাল কিছু হতে সাহায্য করেছেন, তখন তারা আপনাকে বাগিয়ে নিতে কি কি করতে রাজি থাকবে? তার মানে আপনি তখন এমন এক দুর্লভ রত্ন যার জন্য যেকেউ যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তুত। কিন্তু আপনি যদি ফল দেবার আগেই ফল বেচার চিন্তা করতে থাকেন, আর গাছ লাগানো থেকেই বিরত থাকেন, তাহলে দোষ কার?

আমরা বলছিনা যে আমাদের দেশের সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর বর্তমান অবস্থায় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যাপ্লাই করা খুব সহজ কাজ। কিন্তু সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে, আমরা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং আমাদের দৈনন্দিন সমস্যা সমাধান করার জন্য ব্যবহার না করে বরং বই পরে নতুন যে জিনিষটা শিখেছি তা প্র্যাকটিস করার জন্য অ্যাপ্লাই করতে যাই। চেষ্টা করি, ব্যর্থ হই, হাল ছেড়ে দেই। কারণ আমার তো উদ্দেশ্যই ছিল না যে আমাকে একটা মারাত্মক সমস্যার সমাধান করতেই হবে। বরং আমার কাছে এটা একটা অতিরিক্ত এক্সপেরিমেনট। যখন কেউ আমাকে সাহায্য করে না, উল্টো বাধা দেয়, আর আমি ব্যর্থ হই, তখন হাল ছেড়ে দিয়ে কোডে ফিরে যাওয়াই যুক্তিযুক্ত মনে হয়। অথচ এটা যদি আমার কাছে কোটি টাকার সমস্যা মনে হত, তাহলে এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমি ১০০ তা বই ঘাঁটতাম, ১০ তা ফোরামে নিয়মিত পরে থাকতাম, যারা এই কাজে সফল হয়েছে, তাদের কাছে ধর্না দিতাম। আমি ভালো কোডার হতে পারি, কিন্তু তার মানে এই না যে আমি ভালো সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছি – এটা আমাকে বুঝতে হবে। তাই আমি ভুল করব, প্রথম প্রথম কাজ করবে না, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাজ লেগে থেকে এই রহস্যের সমাধান করা। যখন এভাবে আমি একের পর এক সমস্যা সমাধানে পটু হব, তখন আমি একজন সাধারণ টিম লিডের গণ্ডি অতিক্রম করে অনেক দূর চলে গেলাম। তখন আমাকে আর পায় কে?

তারেক সাহেবের আরেকটি বড় ভুল, তিনি নিজেকে আড়াল করে রাখেন। একটা কথা মনে রাখবেন, যখন আপনাকে কেউ চেনে না, তখন আসলেই আপনাকে কেউ চেনে না – মানে আপনি একজন উপেক্ষিত ব্যক্তি। অনেকেই নিজেকে গিক এবং আতেল ভাবতে পছন্দ করেন। মানুষের সাথে কথা বলা, নিজেকে অন্যের কাছে তুলে ধরায় তাদের অনেক অনিহা। মনে রাখবেন এই গিকি আতলামি অপ্রয়োজনীয়। আপনি যদি দক্ষ হন, আপানাকে নিজের দক্ষতা অন্যের উপকারে ব্যাবহার করতে হবে। দক্ষ না হয়ে নিজেকে দক্ষ প্রমাণ করতে চেষ্টা করার মধ্যে লজ্জা আছে, কিন্তু দক্ষ লোকের উচিৎ নিজের দক্ষতাকে যথাযত ভাবে তুলে ধরা। প্রথম প্রথম কথা বলতে গেলে, স্পীচ দিতে গেলে বুক কাঁপবে, গলা দিয়ে কোলা ব্যাঙের স্বর বের হবে, এটাই স্বাভাবিক। যে কারণে আপনি ভাবছেন কেবল আপনারই এমন হয়, তার কারণ আপনি জানেননা যে সবারই এমন হয়। যারা এখন ভালো করছেন, তারা পিছু না হটে প্র্যাকটিস করেছেন, আর বার বার করতে করতে তারা এখন দক্ষ হয়ে গেছেন। কোড করার মতই একই কনসেপ্ট। যে কোড করতে ভয় পায় আর তাই যথেষ্ট কোড করে না, আর যে চেষ্টা করতে করতে এগিয়ে যায় তাদের মধ্যে যা পার্থক্য একই পার্থক্য এখানেও।

সবশেষে জীবনে সামনে এগুতে হলে নিজের খোলস ছেড়ে বের হতে হবে। নিজেকে নিজের গণ্ডি থেকে বের করে আনতে হবে। বেশি বেশি সেমিনার, ইভেন্ট, প্রতিযোগিতা, ট্রেনিং এগুলোতে অংশগ্রহণে আগ্রহী হন। কারণ এগুলো আপনার জ্ঞান বৃদ্ধি করবে আর আপানকে আত্মবিশ্বাস দিবে। সবচেয়ে বড় কথা এক ঘেয়েমি কাটবে, আপনি নিজের জীবন ও কাজ উপভোগ করতে শুরু করবেন। তাই নেতিবাচক মনোভাব পরিহার করুন। এগুলো করে কোন উপকার হয়না, এই মন মানসিকতা আপনাকে কেবল কোড করতে অনুপ্রানিত করে। কিন্তু আপনি জানেনও না যে কখন কোন মানুষের চিন্তা ভাবনা এক মিনিটে আপনার জীবন আমুল পাল্টে দিতে পারে যেটা আপনি হয়তো ১ বছর কোড করেও অর্জন করতে পারতেন না। কিন্তু আপনি যদি কোনায় বসে কেবল কোড করতে থাকেন তাহলে তো আপনি অন্যদের থেকে শিখতে পারবেন না। শিখতে হবে, মানুষের সাথে মিশতে হবে, জ্ঞান অর্জন, চর্চা ও প্রচার করতে হবে। ব্লগ লিখতে থাকুন, সেমিনারে অংশগ্রহণ করুন, ট্রেনিং করুন – মনে রাখবেন শরীরের জন্য যেমন ভাত, মাছ, মাংস, লবণ, পানি ইত্যাদি সবকিছুর সুষম বণ্টন প্রয়োজন, ক্যারিয়ারকে সুস্থ সবল রাখতে হলেও তেমন নানাবিধ কাজ করতে হবে। কেবল কোড করে আপনি নিজের ক্যারিয়ারকে কোনদিন সুস্থ রাখতে পারবেন না।

সকলের জন্য একটি সফল ক্যারিয়ারের শুভকামনা রইল।

মোঃ জালাল উদ্দিন,

প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ডেভস্কিল.কম

Share with Your Friends