Go Back to All Articles যেভাবে একজন প্রোগ্রামারের জীবন ধ্বংস হয় (কেস স্টাডি ২)

জাভেদ সাহেব(ছদ্মনাম) বাড্ডা লিংকরোডে রাস্তার পাশে দাড়িয়ে আছেন। মাত্রই একটা ছোট কোম্পানিতে ইন্টারভিউ দিয়ে বের হলেন। হঠাৎ সবকিছু কেন যেন তার ধূসর মনে হতে লাগলো। জাভেদ সাহেবের বয়স ৪২। দেশের একটা নামকরা বড় কোম্পানিতে প্রোডাক্ট ম্যানেজার পোস্টে আছেন গত ৫ বছর ধরে। তার কাজ একটি বড় ইআরপি সফটওয়্যার এর দেখাশোনা করা ও অন্য জুনিয়র প্রোগ্রামারদের তদারক করা। ইআরপি সফটওয়্যারটির ডেভেলপমেন্টের কাজ শেষ হয়েছে অনেক বছর আগেই। এখন শুধু ছোটখাটো আপডেট আর কাস্টমার সাপোর্ট দিতে হয়। গত ১২ বছর ধরে এই কোম্পানিতে নিজের শ্রম দিয়েছেন তিনি। প্রথম প্রথম ভালই চলছিলো সবকিছু। ভালো বেতন, ফ্যাসিলিটি, সুন্দর অফিস – চাকরিতে সন্তুষ্ট থাকার জন্য যা যা প্রয়োজন সবই তিনি পেয়েছেন। আর তাই চাকরি বদলের কথা চিন্তাও করেননি কখনো। কিন্তু ইদানিং সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল। কোম্পানি আর আগের মত কদর করছে না, উল্টো কেমন যেন একটা উপেক্ষার সুর। তারপরও এই কোম্পানিতে থেকে যাচ্ছেন, না থেকে কি করবেন? কোথায় যাবেন? মাসে অনেক টাকা খরচ তার। সংসার চালাতে হয়, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ তার হাতে। দিনকে দিন খরচ বেড়েই চলেছে কিন্তু গত ৫ বছর ধরে আর বেতন বাড়ছে না। উল্টো কোম্পানি তার বেতনকে এখন বোঝা মনে করে। তাই বেতন বাড়ানোর জন্য চাপও দিতে পারছেন না – যদি উল্টো চাকরিটা চলে যায়, তাহলে কিভাবে সংসার চালাবেন।

তার শঙ্কা ইআরপি প্রোজেক্টটা যদি চলে যায়, তাহলে নিশ্চিত চাকরি হারাবেন তিনি। অন্য দিকে প্রোজেক্ট থাকলেও বিপদ রয়েই যাচ্ছে, জুনিয়ররা এখন ভালই বোঝে প্রোজেক্টটা, তার আর তেমন দরকার হয় না। অনেকগুলো বছর বসে বসেই বেতন গুনছেন তিনি। কোম্পানিও সেটা বোঝে। আর ওখানেই তার ভয়। কিন্তু ইন্টারভিউটা ভালো হল না তার। এমনিতেই উপরের পোস্টে চাকরি খুব কম, নেই বললেই চলে। যেগুলো আছে তা মাঝারি লেভেলের, বেতন তার সংসার খরচের অর্ধেক। এখানেও তারা আসলে ৫-৬ বছরের অভিজ্ঞ লোক খুজছে, ১২ বছরের অভিজ্ঞ কাউকে তারা আশা করেনি। তাই ইন্টারভিউের শুরু থেকেই কেমন একটা অমিল অনুভব করছিলেন। তার উপর তারা এমন সব নতুন জিনিষ নিয়ে প্রশ্ন করছিলো যা আসলে তার জানা নেই। কোড করেন না অনেক বছর হয়েছে। আসলে ডিজাইন বা আর্কিটেক্চার লেভেলেও কাজ করার সুযোগ তার হয়নি তাই ওখানেও নিজেকে প্রমাণ করতে পারেননি। মোট কথা বুঝতে পারছেন, চাকরিটা তার হবে না।

তাই ভাবছেন কি করবেন। কিন্তু ভেবে কোন কূলকিনারা করতে পারছেন না। নতুন করে তো এই বয়সে আবার সব শুরু করার উপায় নেই। নিজেকে তার ডাইনোসর মনে হতে লাগলো, যেন কালের আবর্তনে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া তার কোন পথ খোলা নেই।

উপরের ঘটনাটি আমাদের দেশে একটি কমন ঘটনা। বেশিরভাগ সিনিয়র প্রোগ্রামারের ক্যারিয়ার এভাবে শেষ হয়। কি ভুল ছিল জাভেদ সাহেবের? কেমন হতে পারতো তার ক্যারিয়ার? চলুন একটু ভেবে দেখি-

আমাদের দেশের প্রোগ্রামাররা ক্যারিয়ার প্ল্যানিং নিয়ে বেশি মাথা ঘামান না। তাদের কাছে একটা ভালো চাকরি, আর বছর বছর প্রোমোশন, ইনক্রিমেনটই সফলতার শেষ বিন্দু। কিন্তু কতদিন এভাবে চলবে, বছর ঘুরতে ঘুরতে জীবন কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা তারা চিন্তা করেন না। চাকরিতে ঢোকার পর জীবনকে উপভোগ করাটাই জীবনের রুটিন হয়ে যায়, নিজেকে আপডেট করার জন্য কোন সময় থাকে না। প্রশ্নগুলো হয়ে যায় এমন-

  • অফিসের কাজ শেষে বাসায় যান রাত ৯ টায়, এরপর আবার বই পড়া? নাকি টিভির রিমোটটা নিয়ে বসা?
  • সপ্তাহে ৫ দিন হাড় ভাঙা পরিশ্রম করার পর ছুটির দিনগুলোতে রিসার্চ ও এক্সপেরিমেনট করা, নাকি বালিশটা নিয়ে দুপুর ১ টা পর্যন্ত ঘুমানো আর তারপর বিকেলটা ঘুরতে যাওয়া?
  • অফিসের কাজকে নস্যি মনে করে, নিজে নিজে আরও এডভান্স কাজ করা নাকি অফিসের কাজ করেই হাঁপিয়ে ওঠা?
  • প্রতি বছর একটা নতুন বিষয়ে ট্রেনিং কোর্স করা নাকি, সে টাকা দিয়ে ব্যাংকক, মালয়শিয়া ঘুরতে যাওয়া?
  • টাকা জমিয়ে সার্ভার, সফটওয়্যার কেনা, নাকি নতুন মডেলের মোবাইল সেট কেনা?

এই প্রশ্নগুলো আমাদের জীবনে প্রতিদিন আসে, যদি বেশিরভাগ সময় আমরা প্রথমটিকে বেছে নেই, আর মাঝে মাঝে ২য়টিকে বেছে নেই তাহলে আমাদের ক্যারিয়ার এগিয়ে যাওয়ার কথা। আর যদি উল্টোটা হয়, তাহলে একদিন সেখানে পৌঁছব যেখানে আজ জাভেদ সাহেব পৌঁছেছেন।

শেখা, বই পড়া, ট্রেনিং করা, অনেক বেশি কাজ করা, নিজের কাজটা সেরা ভাবে করা, নিজেকে আরও উন্নত করার দিকে আমাদের কোন আগ্রহ থাকে না, আমরা বরং চিন্তা করতে থাকি, বছর ঘুরে নতুন বছর আসা মানে, আমার বেতন বাড়ানো কোম্পানির দায়বদ্ধতা। আমি যে কোম্পানিতে রয়ে গেলাম, প্রতিদিন অফিস করতে আসি, অফিসের কাজ ঠিকমত করে দেই, এজন্যই আমার বেতন বাড়াতে হবে। আমরা কখনই এটা চিন্তা করি না যে আমার বেতন যত বাড়ল, সেই অনুপাতে আমি নিজেকে গত বছরের থেকে কতটা উন্নত করলাম। যদি গত বছরের আমি আর এই বছরের আমির মধ্যে পার্থক্য হয় সামান্য তাহলে বিপদ নিশ্চিত। আমরা ভুলে যাই, বেতন তো বেতনের মত বারবে, কিন্তু আমার ক্যারিয়ার কি এগোচ্ছে। আজ থেকে ১০ বছর পর আমি নিশ্চয়ই শুধু কোড করবোনা। কাজেই তখন আমি যে রোল প্লে করতে চাই, আমি কি সেদিকে নিজেকে নিয়ে যেতে পারছি?

জাভেদ সাহেব একজন জাঁদরেল সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট হতে পারতেন। নিজে একটা সফটওয়্যার কোম্পানির মালিকও হতে পারতেন। নামকরা একজন ট্রেইনারও হতে পারতেন, যার থেকে নতুন প্রোগ্রামাররা শেখার জন্য যেকোনো মূল্য দিতে প্রস্তত। সবই সম্ভব হত, যদি তিনি নিজেকে সেভাবে গড়ে তুলতেন ও নিজের ভবিষ্যৎকে নিয়ে চিন্তা করতেন। অথচ তিনি চিন্তা করেছেন কেবল বর্তমান নিয়ে।

এভাবে আমাদের দেশে প্রোগ্রামারদের ক্যারিয়ার ধ্বংস হচ্ছে প্রতি বছর। আর তাই দক্ষ ও অভিজ্ঞ লোক এখানে এত দুর্লভ। এভাবে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার ধ্বংস হোক, আমরা কেউ তা চাই না। আর তাই প্রোগ্রামারদের সচেতন করতে ও দক্ষ করে গড়ে তুলতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু আগে আপনাকে সতর্ক হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে। আমরা কেবল সাহায্য করতে পারি। কিন্তু আপনার জীবন আপনার নিজের সিদ্ধান্ত।

মোঃ জালাল উদ্দিন,

প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ডেভস্কিল.কম

Share with Your Friends