Go Back to All Articles যেভাবে একজন প্রোগ্রামারের জীবন ধ্বংস হয় (কেস স্টাডি ১)

বেশ অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন একটি সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করছিলাম। দিন বেশ ভালই যাচ্ছিল, কিছুদিনের মধ্যেই ডাবল প্রমোশন পেয়ে ডেপুটি টিমলিড হয়ে গেলাম, কাজও ভালই চলছিলো। সেখানে একজন কলিগ ছিলেন (ছদ্মনাম হিসাবে ধরে নেই তার নাম – কামাল)। কামাল ভাই বেশ মজার মানুষ, সারাক্ষণ হাসেন আর অন্যদেরও হাসাতে ভালবাসেন। তার কাছে তখন শোনা একটা জোকস এখনও আমার মনে আছে। কিন্তু তিনি চাকরিতে খুব একটা সুবিধা করতে পারছিলেন না। আমি দেখলাম তার মূল সমস্যা দক্ষতা। ইতিমধ্যে অফিস থেকে কয়েকজনকে দক্ষতার জন্য বাদ দেয়া হয়েছে। যাদের বাদ দেয়া হয়েছে তাদের থেকে কামাল ভাই কিছুটা ভালো হওয়ায় এযাত্রায় তাকে বাদ দেয়া হয়নি বরং নিজেকে প্রমাণ করার জন্য সুযোগ দেয়া হল।

আমি বেশ কয়েকদিন উনাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে উনি যদি এভাবে হেসে খেলে সময় পার করতে থাকেন তাহলে উনার বিপদ হতে পারে। আমি বললাম, আপনি কেন নতুন নতুন জিনিষ শিখছেন না? আপানার সাহায্য লাগলে আমি সাহায্য করবো। কিন্তু আপনি কঠোর পরিশ্রম করুন ও ভালোভাবে প্র্যাকটিস করুন। তিনি আমার কথাটা তেমন আমলে নিলেন বলে মনে হল না। উল্টো বললেন, তিনি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট চেষ্টা করছেন। আমি কিছুক্ষণ বুঝানোর চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিলাম। জোর করে তো আর কাউকে সাহায্য করা যায় না…

কয়েক মাস পর একদিন জানতে পারলাম, কামাল ভাইকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়েছে। শুনে মনটা খারাপ লাগলো, কিন্তু জানতাম এমনি হবে। আমি আবার আমার কাজে মন দিলাম, এক সময় ভুলেই গেলাম তার কথা। আরও বেশ কয়েকটা কোম্পানিতে চাকরি করার পর একদিন নিজেই বিজনেস শুরু করলাম। কিছু দিনের মধ্যেই বেশ গুছিয়ে গেল সবকিছু। দেখতে দেখতে ২ বছর পার হয়ে গেল…

একদিন ব্যাংকের এটিএম মেশিন থেকে টাকা তোলার জন্য লাইনে দারিয়ে আছি, এমন সময় কামাল ভাইয়ের সাথে দেখা। মলিন মুখ দেখে জিজ্ঞাসা করলাম কি ব্যাপার। তিনি বললেন, ভাই আমার চাকরি নেই, আমাকে একটা চাকরি দেন। তার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পরলাম, বললাম আবারও চাকরি হারিয়েছেন? তিনি বললেন – আবারও কোথায়, আমি তো ওখান থেকে বের হবার পর আর চাকরি পাইনি। এবার আমি আরও বিস্মিত হলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না, এটা কিভাবে সম্ভব। যতই খারাপ কাজ করুক, কোথাও না কোথাও একটা কোন রকম চাকরি তো ২ বছরে যে কেউ জোগাড় করে নিতে পারবে, এটাই ছিল আমার ধারনা। আমাকে আরও বিস্মিত করে তিনি জানালেন যে অনেক জায়গায় সিভি দেবার পরও কেউ তাকে ইন্টারভিউতেই ডাকে না। আমি এবার নিশ্চিতভাবে তাকে বললাম – তাহলে আপনার সিভিতে কোন সমস্যা থাকতে পারে, কারণ ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি না পেলে বুঝতাম, দক্ষতার অভাব, কিন্তু আপনাকে তো ইন্টারভিউতেই ডাকছে না। আমি উনাকে বললাম, এক কাজ করেন – আপনার সিভিটা আমাকে ইমেইল করে দেন, আমি চেক করে দেখি। তিনি বললেন, ভাই সিভি দেখার সময় নেই, আমার এখনি চাকরি লাগবে, ২ বছর চাকরি ছাড়া থাকলে যে কি হয় আপনি বুঝবেন না। আমাকে আগে চাকরি দেন, সিভি তারপর দেখেন। আমি বললাম কেউ তো আপনাকে যেচে চাকরি দিবে না, আপনাকে আগে সমস্যা বের করে তার সমাধান করতে হবে। ২ বছর চাকরি ছাড়া ছিলেন, এখন না হয় আরও ৬ টা মাস থাকেন কিন্তু এটার একটা সমাধান করে ফেললে তো আর এমন হবে না। তিনি এক রকম রাজি হলেন এই শর্তে যে আমি আমার পরিচিত বিভিন্ন কোম্পানিতে থাকে রেফার করবো। আমি বুঝতে পারলাম, নিজের ভুল শোধরানোর প্রতি তিনি এখনও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। যাই হোক, আমার ইমেইল ও ফোন নম্বর নিয়ে তিনি চলে গেলেন। আমি আশায় রইলাম তার সিভির। কিন্তু তিনি আমাকে আর ইমেইল করেননি, আমিও ভুলে গেলাম তার কথা।

এর আরও ২ বছর পর তিনি আমাকে ফোন দিলেন। বললেন তিনি এখনও চাকরি পাননি এবং অবস্থা আরও খারাপ হয়ে গেছে। তিনি বললেন তিনি আমাকে এখন সিভি ইমেইল করেছেন, আমি যেন চেক করে দেখি ও তার জন্য অতি সত্ত্বর একটা চাকরির বেবস্থা করি। আমি তাকে বুঝাতেই পারলাম না যে এভাবে অনুরধে চাকরি আমি দিতে পারব না। কারণ আমার ক্লায়েন্ট এটা মানবে না। যাই হোক সিভি চেক করে আমি যা বুঝলাম যে তিনি অনেক পিছিয়ে পরেছেন, নতুন জিনিষগুলো তিনি জানেন না। তাই আমি তাকে কিছু প্রশ্ন ও কিছু শেখার গাইড দিয়ে একটা ইমেইল করলাম। আমার ইমেইল পেয়ে তিনি যথেষ্ট হতাশ হলেন এবং বললেন এটা তার কোন উপকারে আসবে না। আমি এই পর্যায় কিছুটা বিরক্তই হচ্ছিলাম এবং তাকে এড়ানোই উপযুক্ত মনে করছিলাম।

এর আরও ২ বছর পর তিনি আমাকে আবার ফোন দিলেন এবং জানালেন যে তিনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন এবং তিনি আমার সাথে দেখা করতে চান। আমি তার ইমেইল দেখালাম এবং বললাম অফিসে আসতে। কিন্তু আমি বুঝতে পারছিলাম, তিনি আমাকে এবার একরকম চেপে ধরে চাকরি নিতে চান, তাই আমি তাকে আগেই সতর্ক করলাম যে এমন কিছুর সম্ভাবনা নেই। যাই হোক তিনি আসলেন, চোখ মুখ বিষণ্ণ, সেই সারাক্ষণ হাসি থাকা মুখে এখন রাজ্যের অন্ধকার। তিনি আমাকে অনেক দুঃখের কথা শোনালেন, আমিও তাকে বললাম যে আপনি যদি আগেই আমার কথা শুনতেন তাহলে আজকে আপনাকে এই দিন দেখতে হত না। তিনি বললেন তার আত্মবিশ্বাস এতটাই ভেঙে গেছে যে তার এখন কিছু শিখতেও ইচ্ছা করে না। মাঝে মাঝে আত্মহত্যা করতে ইচ্ছা করে। আমি তাকে ২ ঘণ্টা ধরে বুঝালাম যে ভুলেও যেন একথা চিন্তা না করেন। আমি বললাম, আমি যথেষ্ট চেষ্টা করবো তার জন্য, কিন্তু আপনি আমার কথামত না চললে আমার কিছুই করার নেই। তিনি আমার উপর হতাশ হয়ে চলে গেলেন। এরপর আরও ২ বছর চলে গেছে, তার সাথে আর কথা হয়নি। জানিনা কোথায় আছেন, কেমন আছেন।

এটি একটি সত্য ঘটনা। আর এই ঘটনা থেকে আমরা যেটা শিখতে পারি তাহল, যে প্রোগ্রামাররা শেখাকে হেলাফেলা করেন, সময় নষ্ট করেন, তাদের কি হয়। এমন নয় যে এটা একজন মানুষের গল্প। হাজার হাজার প্রোগ্রামার একই ভুল করে নিজেদের জীবন ধ্বংস করছেন। একটা চাকরি পেলেই তারা আয়েশে গা ভাসিয়ে দেন। নিজেকে আরও উন্নত করার গুরুত্ত ভুলে যান। আর এই লাইনে যে গায়ের জোড়ে কাজ পাওয়া যায়না, দক্ষতাই একমাত্র সহায়, তাও ভুলে যান। এভাবে যেন আমাদের দেশের প্রোগ্রামারদের জীবন ধ্বংস না হয়, তাই ঘটনাটি শেয়ার করলাম।

মোঃ জালাল উদ্দিন,

প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, ডেভস্কিল.কম

Share with Your Friends